তামাদ্দুন২৪ডটকম:দুপুর ১ টায় নামলাম জুনাগড়হ স্টেশনে। জুনাগড়হ শহরটা পাহাড়ের পাদদেশে। এদিকেটায় ট্রেন ডিজেলে চলে। কারেন্টের লাইন এখনো টানতে পারেনি। আহমেদাবাদ পর্যন্ত কারেন্টে চলে তারপর ডিজেল। জুনাগড়হ এ প্রায় বৃষ্টি হতে থাকে। রোদ আর মেঘের খেলা চলতে থাকে সব সময়।
স্টেশন থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি নিলাম। এখানের রাস্তাঘাট তুলনা মূলক একটু নোংরা। রাস্তায় মানুষের থেকে গরুই বেশি, আর সেই সাথে আছে কুকুর। কিছুক্ষণ পর বাসায় গিয়ে পৌঁছালাম। কিছুটা উপর উঠতে হল। কারণ, এখানে পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি বানানো।
দুপুরে খেয়ে বিকালবেলা একটু বাইরে বের হলাম। সুরাটের মত এই শহরটা তেমন গুছানো না। রাস্তা এবড়োখেবড়ো। তবে শহরের জায়গায় জায়গায় অনেক প্রাচীন প্রাসাদ আছে। সেখানে মানুষের বসবাস নেই। এখানে মুসলমানদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়েই এদিক ওদিক গেলাম। একটু ক্লান্ত ছিলাম বলে রাতে আগে আগেই শুয়ে পরলাম। তাছাড়া পরদিন সকাল সকাল আমাদের প্রবন্দর যাওয়ার কথা ছিল।
ফজরের নামাজ পড়ে জুনাগড়হ এর বিখ্যাত চা খেলাম। চা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। যদিও সকাল সকাল রাস্তার চারিদিকে গরুর গবর দেখে শরীর ঘিন ঘিন করছিল। চারিদিকে খোলা গরু। সে এক মহা বিরক্তিকর ব্যাপার।
চা খেয়ে বাস স্টান্ডে গেলাম। সাথে সাথেই বাস পেয়ে গেলাম। এখান থেকে প্রবন্দর যেতে সময় লাগবে চার ঘন্টা। বেলা ১১ টায় আমরা প্রবন্দর নামলাম। হাতে সময় কম ছিল বলে প্রথমেই সোজা ভারতের প্রাচীন বন্দরে গেলাম। একসময় এটা ভারতের গুরুত্বপূর্ণ একটা বন্দর ছিল। সাগরের ওপাশে আবার পাকিস্তান। সুতরাং এই জায়গা এখনো বেশ গুরুত্ব বহন করে। সমুদ্র পাড়টা দারুণ লাগলো। জুতা পাড়ে রেখে একটু পানিতে নেমেছিলাম, ঢেউ এসে জুতা নিয়ে গেল। ভেবেছিলাম নতুন জুতাটা বুঝি গেল! পরে এরেকটা ঢেউ এসে তা আবার ফিরিয়ে দিয়ে গেল।
প্রবন্দরে আছে সেই মহাত্মা গান্ধীর বাড়ি। কিন্ত সময় স্বল্পতার কারণে যাওয়া হল না। আশেপাশে ঘুরাঘুরি হল অনেক্ষন। যোহরের নামাজ পড়ে খাওয়ার জন্য হোটেলে ঢুকলাম। অর্ডার করলাম এখানের গুজরাটি থালি। আজব ধরনের খাবার নিয়ে আসলো সাথে আছে লাল আটার রুটি। খিদে পেটে খুব একটা খারাপ লাগলো না খাবারটা। খেয়ে একটু বসে আবার ফিরতি পথ ধরলাম। জুনাগড়হ আসতে আসতে আসর হয়ে গেল। মনকে প্রস্তুত করে নিয়েছিলাম বলে তেমন একটা ক্লান্ত হচ্ছিলাম না। রাতে গেলাম পাশের একটা পার্কে। পার্কে গিয়ে দেখলাম কোন মানুষ নেই, ভাবলাম পার্ক হয়তো বন্ধ। পরে জিজ্ঞাসা করে জানলাম খোলা আছে। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকে দেখি পুরা পার্কে ঘুরার জন্য শুধু আমরাই এসেছি। রাইডগুলো বন্ধ। শুধু আমাদের জন্যই রাইডগুলো চালু করলো। বেশ মজা লাগছিল, পুরা পার্ক আমাদের জন্য চালু হয়েছে। গেলাম ভুতের ঘরে, সেই লেভেলের ভয় পেলাম। কারণ, এটা সাথে আমি আগে থেকে পরিচিত না।
ওখান থেকে বের হয়ে একটা ধাবায় গেলাম, টুকটাক কিছু খাওয়া হল। বাসায় ফেরার পথে ফ্রুট সালাদ খেলাম। খাবারটা বেশ মজাদার ছিল, দুই গ্লাস খেলাম। রাতে বাড়ি ফিরলাম। শরীর কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পরেছিল। পরদিন সকাল যাওয়ার কথা ছিল মহাবীর সুলতান মাহমুদ গাজনবীর বিজিত সেই "সোমনাথ মন্দির" এ। কিন্তু সকালে আর উঠতে পারলাম না সহজে। ভাবলাম শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া দরকার। সকাল ৯টার দিকে গেলাম জুনাগড়হ এর মোঘল বাদশাহর কেল্লায়। এই জুনাগড়হ একসময় মুসলমানদের হাতে শাসিত হয়েছে। এখনো শহরজুড়ে তার অনেক নিদর্শন রয়ে গেছে।
কেল্লার ভেতরে দেখলাম মাটির নিচে জেলখানা। সে যেন অন্য এক জগত! আগে কয়েদীদের এখানে রাখা হত। ভেতরে একটা পরিত্যক্ত মসজিদও পেলাম। কেল্লার পিছনের অংশটা ২ হাজার ফিট পাহাড় দিয়ে বেষ্টিত। সেই পাহাড়ের চূড়ায় আছে একটা মন্দির। হিন্দুরা সন্যাসী হতে ওখানে যায়। মন্দিরে ওঠার জন্য ১০ হাজার সিড়ি আছে। কেল্লার উপর থেকে গোটা জুনাগড়হ শহরটা এক নজরে চলে আসে।
কেল্লা থেকে বের হয়ে গেলাম সেই পাহাড়ের পাদদেশে। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে নদী বয়ে গেছে। দৃশ্যটা সত্যিই অসাধারণ ছিল। নদীর ওপারের পাহাড়ে নাকি মাঝে মাঝে বাঘ আর হরিণের দৌড় দেখা যায়। নদীতে পানি খেতেও নামে প্রাণীরা। তবে আমাদের চোখে হরিণ, ময়ূর আর বাদর ছাড়া কিছুই পরল না।
জুনাগড়হ এর বিভিন্ন জায়গায় অনেক পরিত্যক্ত বাড়ি আছে। খবর নিয়ে জানতে পারলাম সেগুলো একসময় মাদরাসা ছিল। এখানে ক্লাস হত। মুসলমানদের জয়জয়কার ছিল সবখানে, কিন্তু সেসব জায়গায় আজ হিন্দুদের উল্লাস। ভাবলে খারাপ লাগে। বাসায় ফেরার পথে এক জায়গায় শুটিং হতে দেখালাম। সম্ভবত "বালটা হাউস" নামক কোনো হিন্দি মুভির শুটিং হচ্ছিল। আমরা দ্রুত বাসায় ফিরলাম। কেননা, আজ দুপুরেই জুনাগড়হ ছাড়ছি রাজকোটের উদ্দেশ্যে। দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বাস স্টান্ডে গেলাম। গিয়েই নন স্টোপেজ একটা বাস পেয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর বাস ছেড়ে দিল, আমরা জুনাগড়হ কে বিদায় জানালাম।
আকাশে মেঘের আনাগোনা ছিল। জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছিল। সূর্য মেঘের আড়ালে চলে গেছে।আমি জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম......
আসরের একটু পরেই আমরা রাজকোট নামলাম। রাজকোট শহরটা গুজরাটের অন্যতম একটি বানিজ্যিক শহর। এই জায়গায়টাও বেশ উন্নত। সুরাটের মত এখানের রাস্তাঘাট পরিস্কার এবং পরিপাটি। রাজকোট গুজরাটের মাঝ বরাবর। এখানে মুসলমানের সংখ্যা কম। কুরবানিতে এখানে পরের দিন কুরবানী দিতে হয়েছে। কারণ, কুরবানির প্রথম দিন হিন্দুদের পূজা ছিল বিধায় মহিষ জবাই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। গুজরাটের সবখানেই মহিষের গোশত। মহিষের গোশত খেতে খেতে এদের কাছে নাকি গরুর গোশত আর ভাল লাগেনা।
বাসস্ট্যান্ডে একজন পরিচিত লোক আমাদের নিতে এসেছিল। রাজকোটে আমরা তার বাসায় থাকব। শুধু নামে শুনেছি এখানে আত্মীয়দেরকে, এটাই প্রথম দেখা। এদিকে না আসা হলে হয়তো জানতামই না এখানেও আমাদের আত্মীয় থাকে। ভেবেছিলাম কেমন না কেমন হবে এরা! কিন্তু পরে এদের আন্তরিকতা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। বাসায় যেতে যেতে মাগরিব হয়ে গেল। রাতে আর বাইরে যাওয়া হল না। খেয়ে নামাজ পড়ে শুয়ে পরলাম। আগামীকাল আবার আবার কোলকাতা ফিরে যাবে আমি একাই রয়ে যাব। এখান থেকে মুম্বাই যাওয়ার ইচ্ছা আছে।
রাতের ঘুমটা বেশ ভাল হল। শরীর ঝরঝরে হয়ে গেছে। ফজরের নামাজ পড়ে সাইফুল ভাইয়ের সাথে গল্প করলাম। এখানের অবস্থা জানলাম। আমরা যেখানে এসেছি এখেনের আশেপাশে মাত্র দুটি মসজিদ আছে। একটা বিদাআতিদের মসজিদ আর অন্যটা সাধারণ মসজিদ। তাবলীগের কাজ এখানে তেমন জোরদার না। মুসলমানের সংখ্যা কম
আম্মুদের ব্যাগ গুছিয়ে দিলাম। দুপুর ১২ টায় আম্মুদের ট্রেন রাজকোট স্টেশন থেকে। ১১:৩০ সে আম্মুদেরকে স্টেশনে দিয়ে আসলাম। জুমার নামাজ পড়তে চলে গেলাম ওখান থেকে। না জেনেই বেদাতিদের মসজিদে উপস্থিত হলাম। এখানে খুতবা হয় হিন্দিতে। প্রথমে বুঝতে পারিনি এটা যে বেদাতিদের মসজিদ। বয়ানের মধ্যে হঠাৎ ইমাম জোরে বলে উঠল "কে বলেছে হুজুর সা. গায়েব জানতেন না?"। সাথে সাথে আমার টনক নড়ে উঠলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম এখান থেকে ওঠার সুযোগ নেই। সুতরাং বাধ্য হয়ে নামাজ পড়তে হল। পরে অবশ্য আবার নামাজ পড়ে নিয়েছি।
নামাজ শেষ করে গেলাম সাইফুল ভাইয়ের সোনার দোকানে। স্বর্নের অনেকগুলো বিস্কুট নেড়েচেড়ে দেখলাম। কিভাবে স্বর্নলংকার পালিশ করে, কিভাবে পাথর বসায় ইত্যাদি। দোকানের চেয়ে ওখানে বেশ দাম কম। এটা অবশ্য সবার জন্য না, উনি বলেছিল আমি চাইলে নিতে পারি। কিন্তু এনে কাওকে দেওয়ার ছিল না বিধায় নিইনি। দুপুরে বাসায় ফিরে মহিষের গোশত রান্না খেলাম। তেমন একটা স্বাদ লাগলো না।
বিকালে গেলাম রাজকোটের একটা চিরিয়াখানায়। চিরিয়াখানাটা অনেক বড় পুরাটা ঘুরে শেষ করা গেল না। যতটুকু পারলাম ঘুরে দেখলাম। যেসব প্রাণী দেখলাম সেগুলোর সাথে অনেক আগে থেকেই পরিচিত।
বাইকে কোরে রাজকোট ঘুরলাম মাগরিব পর্যন্ত। এখানের ট্রাফিক নিয়ম সুরাটের থেকে কড়া। মাগরিবের পর বাসায় এসে অনেককিছু নাস্তা করা হল। আবার মাগরিবের পর বের হলাম রাজকোটের বাকি অংশ ঘুরে দেখতে। রাতের রাজকোটা দারুণ লাগছিলো। একটু বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া শহরটা যেন আরও চকচক করছিল। রাস্তা দাপিয়ে বেড়াতে দেখলাম ল্যামবার্গিনি আর বিএমডব্লিউ আই৮ গাড়িগুলোকে। হায়াবুসা আর কাওয়াসাকির মত বাইকের ও দেখা পাওয়া গেল। বড় একটা শপিংমলে ঢুকলাম। ঘুরেফিরে র্যামন্ড থেকে পাঞ্জাবি কাপড় কিনলাম আমার জন্য।
তারপর গেলাম গুজরাটের প্রসিদ্ধ একটা মেলায়। বছরে একবার হয় ১৫ দিনের জন্য। ভেতরে ঢুকে মনে হল গোটা ভারতের লোক বুঝি আজ এখানে উপস্থিত হয়েছে। হাতঘড়িতে তখন রাত ১০টা। যদিও এখানের জন্য এটা কোনো বিষয় না। তবে আমি যেহেতু আগামীকাল মুম্বাই যাচ্ছি বাসের টিকিট কাটতে হবে।
আমার প্লান ছিল মুম্বাই যাওয়ার আগে গুজরাটের প্রসিদ্ধ শহর আহমেদাবাদ আর বড়দা ঘুরে যাওয়ার। কিন্তু হাতে সময় কম থাকায় তা আর সম্ভব হল না। আহমেদাবাদ আর বড়দা গুজরাটের সব থেকে উন্নত শহর। কেউ ওদিকে গেলে এই দুটো শহর ঘুরে আসতে ভুলবেন না।
ওখান থেকে গেলাম টিকিট কাউন্টারে। প্রথমে ট্রেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কিন্তু সবাই বলল বাসে যেতে। কারণ, ট্রেনে গেলে ফজরের সময় যদি ঘুমিয়ে থাকি আমাকে ডেকে তোলার কেউ থাকবেনা। ট্রেন অন্য জায়গায় নিয়ে চলে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। তাই বাসেই টিকিট কাটলাম ১২শ রুপি দিয়ে। আগামীকাল বিকাল ৫ টা গ্রীনরোড চৌকিটকি থেকে বাস ছাড়বে।
পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে শরীরটা হালকা গরম গরম অনুভব করলাম। ভয় পেয়ে গেলাম জর আসে কিনা! তাহলেই সেরেছে। সারাদিন শুয়ে থাকলাম বিছানায়। বুঝলাম একটু বিশ্রাম দরকার নাহলে শরীর আরও ভেঙে পরবে।
দুপুরে খেয়ে একটু কাইলুলা করে বের হয়ে পরলাম। আমাকে কাউন্টার পর্যন্ত দিয়ে আসলো সাইফুল ভাই। বাস আসতে তখনো কিছুটা দেরি ছিল। আমি সাইফুল ভাইকে বিদায় দিয়ে দিলাম।
কিছুক্ষণ পর বাস আসলো। ১০ চাকার বিশাল বাস। প্রথম সিট টা আমার ছিল। সিঙ্গেল শোয়ার সিট। ভেতরে বালিশ, কম্বল, টাওয়েল রাখা ছিল। আমি পা ছড়িয়ে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসলাম। বাস ছেড়ে দিল গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে। পশ্চিমাকাশে সূর্য হারিয়ে গেছে। আরও একটি দিনের বিদায়। আমি গুজরাট ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম মুম্বাই হাইওয়ে ধরে। ধীরে ধীরে ঘরবাড়ি কমে আসতে লাগলো। আধারের চাদরে ঢেকে যেতে শুরু করেছে আশপাশ....।
নিচে দেওয়া ছবিগুলো সব জুনাগড়হ এর.....
0 মন্তব্যসমূহ