শিরোনাম

[getTicker results="10" label="random" type="ticker"]

মেঘের পাহাড়ে পাহাড়ে

মুনশি মুহাম্মদ আরমান 

প্রচ্ছদ : কাজী হাসানুল বান্না

‘মেঘের রাজ্য সাজেক।’ কথাটির সঙ্গে পরিচিত বছর কয়েক ধরে। হুটহাট প্লানে তাই বেরিয়ে পড়লাম খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে। সঙ্গী চার বাইকে আটজন। রাতের আঁধার চিরে বাইক ছুটলো কুয়াশার পাহাড় ঠেলে। ক্ষণে ক্ষণে নিলাম চা-বিরতি। গুগলম্যাপে একটা সময় নিজেদের আবিষ্কার করলাম রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায়।

দেশের সবচেয়ে বড়ো ইউনিয়ন হিসেবে খ্যাত সাজেক তখনও অনেকটা পথ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ১৮০০ ফুট। সাজেকের অবস্থান রাঙামাটি জেলায় হলেও ভৌগলিক কারণে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে সাজেক যাতায়াত অনেক সহজ। খাগড়াছড়ি জেলা থেকে সাজেকের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার; আর দীঘিনালা থেকে ৪০ কিলোমিটারের মতো।

দীর্ঘ নয় ঘণ্টার বাইক রাইড শেষে ভোর আটটা নাগাদ পৌঁছুলাম বাঘাইহাট আর্মি ক্যাম্প। সাজেক যেতে হলে অবশ্যই এখানকার পুলিশ ও আর্মি ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিতে হয়। দিঘীনালার এই আর্মি ক্যাম্পে সকাল ৯টা থেকে ৯টা ৩০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছুতে হবে। দিঘীনালা থেকে বাকি রাস্তা নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনীর এসকোর্টে যেতে হয়।

সেনাবাহিনীর এসকোর্ট দিনে দু’বার পাওয়া যায়। সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে একবার, ২টা ৩০ মিনিটে আরেকবার। সকালের এসকোর্ট মিস করলে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর বিকেলেরটা মিস করলে পরদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আবার এসকোর্ট ছাড়া একা যাবার অনুমতি নেই।

আর্মিদের অফিসিয়াল কার্যক্রম শেষে তাদের এসকোর্টেই রওনা হলাম পাহাড়ি পথ ধরে। সারি সারি উঁচু পাহাড় কেটে কেটে তার মধ্যেই গড়ে তুলেছে চোখ ধাঁধানো ভয়ংকর রাস্তা। বিশতলা উঁচু সমান রাস্তা থেকে নিচে নামছি, কখনো বা বিশতলা উঁচু সমান পাহাড়ের রাস্তায় উঠছি। বুকটা কেমন ধুপক ধুপক করে কেঁপে উঠছিলো যেনো।

টানা আড়াই ঘণ্টায় পঁয়তাল্লিশ কিলো আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করে পৌঁছুলাম নয়নাভিরাম সাজেকের গন্তব্যে। চারপাশে মনোরম পাহাড়ি সারি, সাদা তুলোর মতো মেঘের ভ্যালি আমাদেরকে যেনো মুহূর্তেই মুগ্ধ করে তুললো।

থাকার জন্য হোটেলের খোঁজ শুরু করলাম। সাজেকে থাকার জন্য চল্লিশোর্ধ রিসোর্ট ও আদিবাসী কটেজ আছে। এক রাতের জন্য জনপ্রতি ২০০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া। ছুটির দিনে যেতে চাইলে মাসখানেক আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। নয়তো ভালো রুম পাবার নিশ্চয়তা কম থাকে। আর কম দামে থাকতে চাইলে আদিবাসী কটেজগুলোতে থাকা যায়। এ ছাড়া বর্তমানে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নতুন নতুন অনেক কটেজ হয়েছে। সাজেকের সব কটেজ থেকেই মোটামুটি সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। আমরা পনেরোশো টাকার দুটি রুম নিলাম।

রুমে এসে খানিকটা বিশ্রাম নিলাম। এরই ভেতর এলো দুপুরের খাবারের তাগাদা। এখানকার সব রিসোর্টে খাবারের দারুণ ব্যবস্থা আছে। আলু ভর্তা, মুরগির মাংস দিয়ে মধ্যাহ্নের খাবার সেরে নিলাম। রাতের জন্য বার-বি-কিউ, ব্যাম্বো চিকেন বুকিং দিয়ে রাখলাম। সাজেকে খুব সস্তায় পেঁপে, আনারস, কলা, ইত্যাদি ফল পাওয়া যায়। খাওয়াদাওয়া শেষে সেগুলোও চেখে দেখতে ভুললাম না।

রুমে এসে ফের খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সাজেক চষে বেড়াতে। সাজেক এমনই এক আশ্চর্যজনক জায়গা, যেখানে একই দিনে প্রকৃতির তিন রকম রূপের সান্নিধ্যে আমরা চমৎকৃত হলাম। কখনো বা খুব গরম অনুভূত হলো; তারপর হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে গেলাম; আবার চোখের পলকেই মেঘের ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেলো আমাদের চারপাশ।

প্রাকৃতিক নিসর্গ আর তুলোর মতো মেঘের পাহাড় থেকে পাহাড়ে ওড়াউড়ির খেলা দেখতে দেখতে মনে হলো, সাজেক একটি আদর্শ জায়গা। সন্ধ্যের হালকা নাস্তা সেরে চলে গেলাম হেলিপ্যাডে। সেখানে বসলো আগত পর্যটকদের গানের আসর। একজন গাইছে, তার সঙ্গে সুর তুলছে অন্যরা। নিজেকে হারিয়ে ফেললাম এক গহীন গগনে। যেখানে আমরা ছাড়া চারপাশে দ্বিতীয় কেউ নেই।

গানের আসর শেষে রাতের খাবার খেতে বসলাম। বার-বি-কিউ এবং ব্যাম্বো চিকেনের সঙ্গে পরোটার মাখামাখিতে দারুণ মস্তি হলো আমাদের। রিসোর্টে ফিরে চটজলদি শুয়ে পড়লাম খুব সকালে ওঠার তাগিদে।

পরদিন খুব ভোরে চোখ মেললাম। দলবেঁধে ছুটলাম কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। কংলাক পাহাড় হচ্ছে সাজেক ভ্রমণে আসা পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। আর সাজেক ভ্যালির শেষ গ্রাম কংলাক পাড়া লুসাই জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা। কংলাক পাড়া থেকেই কর্ণফুলী নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের লুসাই পাহাড় দেখা গেলো। রুইলুই পাড়া থেকে ঘণ্টা দুই ট্রেকিং করে পৌঁছুলাম কমলক ঝর্ণায়।

সুন্দর এ ঝর্ণাটি অনেকের কাছে পিদাম তৈসা ঝর্ণা বা সিকাম তৈসা ঝর্ণা নামেও বেশ পরিচিত। আমাদের কাছে মনে হলো, দিন কিংবা রাত সাজেক যেনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো। সময় গড়ায়, তবু সাজেক তার আকর্ষণ হারায় না। সাজেকের ভোরের সময়টা মিস করা বোকামি। মেঘের খেলা আর সূর্যোদয়ের আলোর মেলা এই সময়েই বসে। তাই খুব ভোরে উঠে চলে যাওয়া হেলিপ্যাডে। সেখান থেকেই সবচেয়ে সুন্দর সূর্যোদয় দেখা গেলো।

পড়ন্তবেলায় একটি উঁচু জায়গা থেকে সূর্যাস্তের রঙিন রূপে বিমোহিত হলাম। আর সন্ধ্যের পর আকাশের কোটি কোটি তারার মেলা প্রাণ জুড়িয়ে দিলো নিমিষেই। ঝকঝকে আকাশের নিবিড় পরিবেশে দেখা মিললো মিল্কিওয়ে বা ছায়াপথের।

এসবের ভীড়ে ঘুরে দেখতে ভুললাম না চারপাশ ও আদিবাসীদের জীবনযাপন। সহজ সরল এসব মানুষের সান্নিধ্য অনিমেষ ভালোলাগায় ভরে উঠলো আমাদের প্রাণ।

খিলগাঁও, ঢাকা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ