মুতিউর রহমান ➤
প্রচ্ছদ : কাজী হাসানুল বান্না |
ছোটো বোনের শ্বশুরবাড়ি দাওয়াত। ঢাকা ছেড়ে সুদূর সিরাজগঞ্জ রওনা হলাম। দীর্ঘ সফর। অবসাদের অন্ত নেই। শেষমেষ সন্ধ্যে নাগাদ গন্তব্যে পৌঁছুলাম। রাতের আহার সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সারাদিনের ক্লান্তি যেনো সূ্র্য ওঠার আগেই ম্লান হয়ে গেলো৷
পরদিন বোনের ছোটো দেবরের বিয়ের চলনের দাওয়াত। ওর কাছে জানতে পারি, সেখানে নৌকায় চড়ে যেতে হয়। মহাবিপাকে পড়ে গেলাম। কারণ নদীপথে ভ্রমণ করাটা আমার কাছে দুশ্চিন্তার। যদিও নদীমাতৃক এলাকায় শৈশব-কৈশোরের লম্বা একটা সময় কেটেছে। বিভিন্ন বাহানা দেখিয়ে তাই শেষ রক্ষাটুকু পেলাম।
সবাই যেহেতু দাওয়াতে গেছে, তাই কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে হলো। ফেসবুকজগতে পা রাখার পর থেকে অনেকের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছে বেশ। তাদের উল্লেখযোগ্য একজন—বগুড়ার মুফতি সালাহুদ্দীন মাসউদ সাহেব৷ বগুড়ার আরও অনেকেই আছেন, যারা তাদের দাওয়াত কবুল করার জন্য একধরনের পীড়াপীড়ি করলেন৷ তাই বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আসরের আগেই পৌঁছে গেলাম শহরের এক পরিচিতের বাড়ি।
বাদ আসর মধ্যাহ্নভোজের পর্বটা চুকে নিলাম। এরপর জামিল মাদরাসা জেয়ারতে হাজির হলাম। বিকেলজুড়ে মাদরাসার সুদর্শন ভবনগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যে নেমে এলো। মাগরিবের আজান ভেসে এলো কানে। নামাজ পড়লাম সুবিশাল জামে মসজিদে। সত্যিই মসজিদটা দেখতে অসাধারণ। প্রথম দেখায় বেশ মুগ্ধ হয়ে পড়লাম।
বাদ মাগরিব কাঙ্খিত সালাহুদ্দীন মাসউদ ভাইয়ের সাক্ষাৎ। প্রথম দেখাতেই তিনি আপন করে নিলেন। মোয়ানাকার জন্য এগিয়ে এলেন। মনে হলো, যেনো বহু পুরোনো বন্ধু সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। ভাইয়ের সঙ্গে অনেক কথা হলো। তিনি অনেক অনুরোধ করলেন তাঁর বাড়ি যাওয়ার জন্য। কিন্তু সময়ের অভাবে সুযোগ হলো না। অগত্যা ফেরার পথ ধরতে হলো। তিনি কিছু আতর হাদিয়া দিলেন। রাতযাপনের জন্য প্রিয় ছাত্র তালহার বাসায় এলাম।
রাতের আহার শেষে শুয়ে পড়লাম। পরদিন কাকডাকা ভোরে সাতমাথা থেকে এলাম দর্শনীয় স্থান—মহাস্থানগড়৷ ১৮০৮ সালে ‘বুচানন হামিল্টন’ সর্বপ্রথম যার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে ১৯৩১ সালে যাকে প্রাচীন পুন্ড্রনগরী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
মহাস্থানগড়ে চোখে পড়লো বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এর মধ্যে—বৈরাগীর ভিটায় দুটি মন্দিরের অবশিষ্টাংশ, খোদারাপাথার ভিটা, কালীদহ সাগর ও পদ্মাদেবীর বাসভবন, শীলাদেবীর ঘাট, জিউৎকুণ্ড কুপ, মানকালির দ্বীপে ১৫ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের অবশিষ্টাংশ, গোবিন্দ ভিটা, তোতারাম পণ্ডিতের ধাপ এবং গোকুল মেধ উল্লেখযোগ্য। এটি বেহুলার বাসরঘর অথবা লখিন্দরের মেধ নামে পরিচিত।
এ ছাড়া ইস্কান্দারের ধাপ, খুল্লানার ধাপ, মাহি সওয়ার মাজার শরিফ, ভীমের জঙ্গল, জগির ভবন, অররা, তেঘর, রোজাকপুর, মাথুরা, মহাস্থানগড় জাদুঘর এবং পরশুরামের প্রাসাদ নজর কাড়লো। বলতে গেলে অনেকটাই আমরা পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সত্যিই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পুরো মহাস্থানগড় আবৃত। আমরা এখান থেকে ছুটলাম পার্শ্ববর্তী বেহুলার বাসরঘরে।
চম্পাই নগরে চাঁদ সওদাগর নামে এক ব্যবসায়ী ছিলেন। মনসাদেবী বরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন চাঁদ সওদাগর। যদি তিনি মনসা পূজা দেন, তাহলে ত্রিলোকে মনসার পূজা প্রচলিত হবে। তবে পুরোপুরি মনসাবিদ্বেষী ছিলেন চাঁদ সওদাগর। তাই তিনি রাজি হলেন না। চাঁদ সিংহল বাণিজ্য শেষ করে ফেরার পথে কালিদাহ সাগরে মনসাদেবী ঝড় সৃষ্টি করে। সবগুলো জাহাজ জলে তলিয়ে গেলেও প্রাণে বেঁচে যান চাঁদ সওদাগর। ঐ সময়ে চাঁদ সওদাগরের এক পুত্র জন্ম হয়। নাম—লখিন্দর। কিন্তু এক গণক ভবিষ্যৎবাণী করে বলেন, ‘বাসরঘরে লখিন্দরকে সাপে কাটবে।’
লখিন্দর প্রাপ্ত বয়স্ক হলে বেহুলার সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করা হয়। তাদের জন্য তৈরি করা হয় লোহার বাসরঘর। বাসররাতে অনেক নিরাপত্তা থাকাসত্ত্বেও মনসাদেবী সূতোর আকার ধারণ করে ঘরে প্রবেশ করে লখিন্দরকে দংশন করে।
সে যুগের রীতি ছিলো, সাপের কামড়ে কেউ মারা গেলে দাহ না করে ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হতো। লখিন্দরের সঙ্গে ভাসিয়ে দেওয়া হলো বেহুলাকে। ছয় মাস ধরে জলে ভাসতে ভাসতে এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম গেলো। একসময় পচন ধরা শুরু হলো লখিন্দরের দেহে।
বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা করতে থাকে স্বামীর প্রাণভিক্ষা চেয়ে। একসময় ভেলাটি এসে ঠেকে একটি গ্রামের ঘাটে। সে গ্রামে বাস করতো মনসার পালক মা নিতা। নিতা ঘাটে বসে দেখতে লাগলো মনসার কাছে ভক্ত বেহুলার প্রার্থনা। তার মন গলে গেলো। অবশেষে নিতা অলৌকিক ক্ষমতাবলে বেহুলা ও মৃত লখিন্দরকে স্বর্গে উপস্থিত করেন।
চোখ খুলে বেহুলা দেখতে পেলো মনসাকে। মনসা বলে উঠলেন, ‘তুমি তোমার স্বামীকে ফিরে পাবে। তবে শর্ত হচ্ছে, তোমার শ্বশুরকে আমার পূজারী করতে হবে।’ বেহুলা উত্তর দিলো, ‘আমি পারবো, মা!’ সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকায় লখিন্দর। নিতার সাহায্যে আবার মর্ত্যে ফিরে এলো বেহুলা। তার শ্বশুরকে সব ঘটনা খুলে বললো। এরপর চাঁদ সওদাগরের পক্ষে মনসার পূজায় না বলা আর সম্ভব হলো না।
কিংবদন্তির গল্পগাঁথা যে বেহুলা-লখিন্দরকে নিয়ে, সেই বেহুলা ছিলেন সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার বারুহাস ইউনিয়নের বিনসাড়া গ্রামের মেয়ে। ওখানকার ঐতিহাসিক এক জমিদার বাড়ির দুলালী কন্যা ছিলেন। অনিন্দ্য রূপে-গুণের অধিকারিণী বিশ্বনন্দিতা বেহুলা। ষোড়শ শতাব্দের প্রাচীন লোককাহিনির সতী-সাবিত্রী কিংবদন্তির নায়িকা বেহুলা সুন্দরীর বাবার নাম বাছোবানিয়া ওরফে সায় সওদাগর। সিরাজগঞ্জের তাড়াশে আছে বেহুলার পৈতৃক ভিটায় জীয়নকূপ। আর বগুড়ার গোকূলে যুগের পর যুগ পাড়ি দিয়ে টিকে আছে তার বাসরঘর।
বগুড়ার গোকুল মেধ নামক স্থানটি বেহুলার বাসরঘর অথবা লখিন্দরের মেধ নামেও পরিচিত। বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে গোকুল গ্রামে খননকৃত এই প্রত্নস্থলটির অবস্থান। প্রত্নস্থলটি এ দেশের জনপ্রিয় লোকগাঁথার নায়ক-নায়িকা বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর বলে জনসাধারণের কাছে পরিচিত।
এখানে একটি বৌদ্ধ স্তম্ভ রয়েছে। যা সম্রাট অশোক নির্মাণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়। স্তম্ভের উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। স্তম্ভের পূর্বার্ধে রয়েছে ২৪ কোণ বিশিষ্ট চৌবাচ্চাসদৃশ একটি বাথরুম। এখানে ১৭২টি চারকোণা কক্ষসহ একটি মঞ্চ পাওয়া যায়।
তবে এ স্থানটিকে লখিন্দরের মেধও বলা হয়ে থাকে। ১৯৩৪-৩৬ সালে এন.জি মজুমদার কর্তৃক খননের ফলে এখানে একটি বিশাল মন্দিরের বা স্তুপের ভিত্তি উন্মোচিত হয়েছে। এ ভিত্তিটি স্তরে স্তরে উঁচু করে কুঠুরি নির্মাণ রীতিতে নির্মিত।
বেহুলার বাসরঘরে ১৭২টি কুঠুরি বিভিন্ন তলে মাটি দিয়ে ভরাট করে নিচ থেকে ওপরের দিকে ক্রমহ্রাসমান করে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে এগুলো কোনো সুউচ্চ মন্দির বা স্তূপের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এরূপ স্তরে উঁচু করা বহুতল বিশিষ্ট সমান্তরাল ঠেস দেয়ালযুক্ত ভিতের ওপর প্রকৃত স্থাপত্য নির্মাণরীতি প্রাচীন বাংলার একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য।
এ মন্দিরের সঙ্গে পরবর্তী গুপ্তযুগের (ছয়-সাত শতক) কতোগুলো পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে। সেন যুগে (১১শ- ১২শ শতক) এখানে বারান্দাযুক্ত একটি বর্গাকৃতির মন্দির নির্মিত হয়েছিলো। এ মন্দিরে বহু গর্তযুক্ত একটি ছোটো প্রস্তর খণ্ডের সঙ্গে ষাঁড়ের প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ একটি সোনার পাত পাওয়া গেছে। এ থেকে ধারণা করা হয়, এটি একটি শিব মন্দির ছিলো।
বেহুলার বাসরঘর একটি অকল্পনীয় মনুমেন্ট। বর্তমান গবেষকদের মতে এ মনুমেন্ট ৮০৯ থেকে ৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেবপাল নির্মিত একটি বৈদ্যমঠ। এ স্তূপটিই বাসরঘর নয়। এ স্তূপটির পশ্চিমার্ধে আছে বাসরঘরের প্রবাদ স্মৃতিচিহ্ন। পূর্বার্ধে রয়েছে ২৪ কোণ বিশিষ্ট চৌবাচ্চাসদৃশ একটি বাথরুম। সবমিলিয়ে সকাল থেকে প্রায় তিন ঘণ্টার লম্বা একটা সফর হয়ে গেলো। সূর্যর প্রখরতা বেড়ে চললো ধীরে ধীরে। ক্লান্তিও আমাদেরকে বড্ডোরকম পেয়ে বসলো।
লেখক : শিক্ষক, মারকাযুল উলুম আশ শারইয়্যাহ, সাভার, ঢাকা
0 মন্তব্যসমূহ